
তুষার, তুর্কি, তিক্ততা ও একটুখানি মানবতা – ইস্তাম্বুলের এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
Published
তুষার, তুর্কি, তিক্ততা ও একটুখানি মানবতা – ইস্তাম্বুলের এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
সময় ১৫ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ (করোনা মহামারী চলাকালীন সময়)
ভেবেছিলাম দেশের ফেরার পথটা হবে শান্তিময়। তুরস্কের ইস্তাম্বুল সফরটা শেষ দিকে ছিলো নিঃসঙ্গ, শীতল আর বিষণ্ণ। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে আমি হয়ে পড়েছিলাম ক্লান্ত এক পর্যটক। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা অপেক্ষা করছিল শেষ মুহূর্তে।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো করেই আমি ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। ইমিগ্রেশন শেষ, বোর্ডিং পাস হাতে। ফ্লাইট ছিলো Turkish Airlines এর, গন্তব্য ঢাকা। গেটের সামনে বসে এক কাপ চা হাতে অপেক্ষা করছিলাম বোর্ডিংয়ের। কিন্তু যতবারই লাইনে দাঁড়াই, আমাকে পাশ কাটিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। বুঝতেই পারছিলাম না কেন আমাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না।
শুধু আমিই নই—আরো দু-একজন যাত্রী, সম্ভবত পাকিস্তানি বা অন্য কোনো দেশের নাগরিক, তারাও এই একই ভোগান্তির শিকার। অবশেষে জানানো হলো, ফ্লাইটে যাত্রী সংখ্যা সীমিত। হয়তো ২৬০ বা ৩০০ জন পর্যন্ত নেওয়া যাবে, বাকিদের পরে উঠাতে হবে।
ততক্ষণে আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশে পরিবার জানে আমি ফিরছি। গাড়ি নোয়াখালী থেকে এসে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে। ডলারসহ যাবতীয় খরচ শেষ। আমি পুরোপুরি প্রস্তুত দেশে ফেরার জন্য। অথচ এখন বলছে, আমাকে থাকতে হবে—কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কেউ সঠিকভাবে জানে না।
ইমিগ্রেশন তো শেষ—ফিরে যাওয়ার মানেই নতুন করে প্রবেশ, যার জন্য প্রয়োজন ভিসা। রাত বারোটার পর থেকে ভোর পর্যন্ত আমি শুধু ছুটেছি এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে। কেউ সাহায্য করেনি। এমনকি একজন কর্মকর্তা স্পষ্টভাবে ঘুষ চেয়েছেন ইনস্ট্যান্ট ভিসা করে দেওয়ার কথা বলে।
ঠিক যখন মনে হচ্ছিল, সব কিছুই শেষ—তখনই এক অচেনা মানুষের দেখা পেলাম। তিনি আমার কথা বুঝলেন, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলেন। নিজ হাতে নিয়ে গেলেন ইমিগ্রেশন অফিসারে কাছে। তিনি বুঝে নিলেন সমস্যাটা। আমার এক্সিট সিল ক্যানসেল করে, আমাকে আবার তুরস্কে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
তারপর সত্যিই এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। Turkish Airlines আমাকে একটি বিলাসবহুল ফাইভ-স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করলো, গাড়ি করে পৌঁছে দিলো, খাবার দিলো। মনে হচ্ছিল আমি যেন আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছি।
পরদিন নতুন ফ্লাইট ধরার সময় আবার এক দুশ্চিন্তা—চারপাশ বরফে ঢাকা, তুষারপাত এত তীব্র যে হাঁটতে গিয়ে কোমর পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলাম! জানলা দিয়ে দেখছিলাম এয়ারকাফ্ট কিভাবে উড়বে এমন অবস্থায়! কিন্তু তাদের আধুনিক যন্ত্র আর ব্যবস্থাপনায় প্লেন ঠিকই উড়ে গেলো।
অবশেষে আমি বাংলাদেশে ফিরলাম—ভাঙা মন, ক্লান্ত শরীর আর এক গভীর অভিজ্ঞতা নিয়ে।
আজও আমার পাসপোর্টে সেই ক্যান্সেল সিলটি আছে, আর মনে সেই রাতে এয়ারপোর্টে অসহায় দৌড়াদৌড়ি করার ক্লান্ত স্মৃতি।
